গন্ধবিধুর ধূপ

A blog of Freedom Fighter Moktel Hossain Mukthi মুক্তিযোদ্ধা মুক্তির একটি ব্লগ

Wednesday, July 4, 2018

শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত ভাষাসৈনিক হালিমা খাতুন

শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত ভাষাসৈনিক হালিমা খাতুন

আবৃত্তিকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রজ্ঞা লাবনীর শ্রেদ্ধেয় মা হালিমা খাতুন ছেষট্টি বছর আগে যে আমতলায় বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন, সেখানেই প্রিয়জনের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হলেন চির বিদায় নেওয়া ভাষা সংগ্রামী হালিমা খাতুন।
বুধবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলী পর্বে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা তার প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানান।
দীর্ঘ দিন রোগ ভোগের পর রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার দুপুরে মারা যান ৮৬ বছর বয়সী এই ভাষা সৈনিক।
রাতে ধানমণ্ডি নাতনীর বাসভবনে ফ্রিজিং ভ্যানে রাখা হয় হালিমা খাতুনের মরদেহ। বুধবার সকাল সোয়া ১১টার দিকে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।
সেখানে শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জেএসডি (নাজমুল হক প্রধান), সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর, ভাষা আন্দোলন স্মৃতিরক্ষা পরিষদ, উদীচী, খেলাঘর, ছায়ানট, পেশাজীবী নারী সমাজ, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ আরো অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
এ পর্বে হালিমা খাতুনের একমাত্র সন্তান আবৃত্তিশিল্পী প্রজ্ঞা লাবণী বলেন, “ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির পথ ধরে থেকে যাবেন হালিমা খাতুন। তার নাম উচ্চারিত হবে পরবর্তী প্রজন্মের কণ্ঠে।”

প্রজ্ঞা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত শিশুতোষ বইগুলো দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিলিয়ে গেছেন শিশু সাহিত্যিক হালিমা খাতুন।
কিন্তু তার একটি বইও শিশুদের পাঠ্যক্রমে যুক্ত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন প্রজ্ঞা। পরে সরকারের কাছে দাবি জানান, তার মায়ের লেখনী যেন শিশুদের পাঠ্য তালিকায় সংযুক্ত করা হয়।

এই পর্বে ব্যক্তিপর্যায়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন হালিমা খাতুনের সহযোদ্ধা ভাষা সংগ্রামী রওশন আরা বাচ্চু।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারিতে সবাই আমাদের বলেছিল, ‘তোমার আজ লড়াই করো না। জীবনমরণের প্রশ্ন।’ কিন্তু আমরা সেদিন কথা শুনিনি কারো। আমরা ১৪৪ ধারার ব্যারিকেড ভাঙ্গব। হালিমা রইল আমাদের সঙ্গে একেবারে মিছিলের সামনে। আমরা যদি সেদিন ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গতাম, যদি সেই আত্মত্যাগ না করতাম.. তবে আজকে বাংলা ভাষা কোথায় থাকত!

“হালিমা চলে গেল। কিন্তু ওর স্মৃতিগুলো তো রক্ষা করা যায় নানাভাবে। আমরা থাকব না একদিন। আমাদের কথা জানাতে হবে পরের প্রজন্মকে।”

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান জানান, হালিমা খাতুনের সঙ্গে তার ৬৫ বছরের সম্পর্কে যতিচিহ্ন পড়ল মঙ্গলবার।
“আমি হালিমা খাতুনকে আমার বড় বোনের মতো জানতাম। তিনি আমাকে অনুজের মতো স্নেহ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আমার সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু আমরা একইসঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছি। দীর্ঘকালের এই সম্পর্ক আজ শেষ হল,”বলতে বলতে আবেগ্লাপুত হয়ে পড়েন প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর অভিযোগ, দীর্ঘকাল অসুস্থ থাকার পরও সরকার বা সামাজিক কোনো সংগঠন হালিমা খাতুনের শারীরিক অবস্থার ‘কোনো খোঁজ করেননি’।

পরে তিনি বলেন, “দুঃসাহসী এই মহিলা একাধারে একজন সাহিত্যিক, রাজনীতি ও সমাজ সচেতন মানুষ ছিলেন। প্রগতিশীল ধারায় বিশ্বাস করতেন। তার মতো মানুষের খোঁজ না নেওয়া রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। তার মৃত্যুতে আজ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি ধারা নির্বাসিত হয়ে গেল।”

ভাষা সংগ্রাম ও পরে সাহিত্যে অবদান রাখার জন্য হালিমা খাতুনকে একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক প্রদান না করায় হতাশা প্রকাশ করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ।
তার মতো নিভৃতচারী মানুষরা কখনো পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে চান না। তার নিভৃতে মানুষের জন্য কাজ করতে ভালোবাসেন। তিনি দেশের উদ্দেশ্যে যা বলতে চেয়েছিলেন, তা তার লেখনীর মাধ্যমে জাতিকে বলে গেছেন।” 

প্রাবন্ধিক মফিদুল হক বলেন, “হালিমা খাতুন আজীবন মুক্তির সাধনা করে গেছেন। তিনি মননের উত্তরণে যে আদর্শ রেখে গেছেন, তার বিনাশ হবে না কখনও। চির উজ্জ্বল এই আদর্শ আমাদের পথ দেখাবে আগামীতে।” 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।

শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষে হালিমা খাতুনের মরদেহ নিয়ে আসা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে জানাজার পর তাকে দাফন করা হবে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে।

যদি আর বাশী না বাজে- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম

যদি আর বাশী না বাজে- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম

বন্ধুগণ,
আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনুমন প্রান আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে, তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে-আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেইদিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভাল লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহন করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তুর্য বাদকের একজন আমি, এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।
আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের। কবি চায়না দান, কবি চায় অঞ্জলী কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ সুন্দরকে স্বীকার করতে হয় যা সুন্দর তাই দিয়ে সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার ধর্ম। তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভারা জলও দেখেছি। শ্বশানের পথে, গোরস্থানের পথে তাঁকে ক্ষুধা দীর্ণ মুর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি, যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি।
আমাকে বিদ্রোহী বলে খামোখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নিরীহ জাতটাকে আছড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অত্যাচারের বিরুদ্ধে।যা মিথ্যা কুলুষিত পুরাতন পঁচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভন্ডামী ও কুষ্কারের বিরুদ্ধে। কেউ বলেন, আমার বাণী যবন কেউ বলেন কাফের, আমি বলি ও দুটোর কেনটাই নই আমি কেবল মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডসেক করাবার চেষ্টা করেছি গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মেলান যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভন হয়ে থাকে তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগপেতে হবেনা। কেননা এক জনের হাতে আছে লাঠি আর একজনের আস্তিনে আছে ছুরি। হিন্দু-মুসলমানে দিন-রাত হানা-হানি জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র-ঋন-অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষান স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এই অসাম্য ভেদ জ্ঞানকে দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাইনা খ্যাতি চাইনা প্রতিষ্ঠা চাইনা নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে, সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত এই আমার সাধনা এই আমার তপস্যা।
রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, “দেখ উন্মাদ তোর জীবনে শেলীর মত, কীট্সের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে-তুই প্রস্তুত হ” জীবনের সেই ট্র্যাজেডি দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারণে অন্যের জীবনকে অশ্রুর পরশায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু আমারই জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত তপ্ত মেঘের উর্দ্ধে শুন্যের মতো কেবল হাসি কেবল গান কেবল বিদ্রোহ। আমার বেশ মনে পড়ছে একদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা- আমার ছেলে মারা গেছে, আমার মন তীব্র পুত্রশোকে যখন ভেঙ্গে পড়ছে ঠিক সেই দিনই সেই সময়ে আমার বাড়ীতে হাস্নাহেনা ফুটেছে। আমি প্রানভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম। আমার কাব্য আমার গান আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে। যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকীত্বের পরম শুন্য থেকে অসময়ে নামতে হয় তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল; সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পূর্ন্যত্বের তৃষা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুন এই ধরায় এসেছিল অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্না যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল।
যদি আর বাঁশি না বাজে- আমি কবি বলে বলছিনে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি-আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন, আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলামনা বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।
যেদিন আমি চলে যাব সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে, দেশপ্রেমিক-ত্যাগী-বীর-বিদ্রোহী বিশেষণের পর বিশেষণ, টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পড় মেরে, বক্তার পর বক্তা এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে-বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো, তোমার ঘরের আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি-
“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিবনা
কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙ্গিবনা
নিশ্চল-নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী
গন্ধ বিধুর ধূপ”।।